সায়ীদ আলমগীর ::
# ভয়ে সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না সাক্ষীরা
# পুলিশ কাকে আসামি করেছে ক্ষতিগ্রস্তরা জানে না
# গ্রেফতারদের অনেকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন
কক্সবাজারের রামু-উখিয়া-টেকনাফে বৌদ্ধবিহার ও বসতিতে দুর্বৃত্তের হামলার ৭ বছর পূর্ণ হলো আজ। ঐতিহ্য পুড়িয়ে সুরম্য অট্টালিকা ও নিরাপত্তা বলয়ে হারানো পূর্বের সম্প্রীতি ফিরেছে, মুছে গেছে ক্ষতও। কিন্তু সাক্ষীর অভাব ও বৈরী সাক্ষ্যের কারণে শেষ হচ্ছে না মামলার বিচার কার্যক্রম।
এ ঘটনায় করা ১৯ মামলায় ১৫ হাজার ১৮২ আসামির কম-বেশি সবাই জামিনে রয়েছেন। ৫২৬ জন গ্রেফতার হওয়ার পর জামিন নেন আর বাকিরা আত্মসমর্পণ করে জামিন পেয়েছেন বলে জানিয়েছে আদালত সূত্র। তবে এখনও প্রায় শতাধিক অভিযুক্ত পলাতক রয়েছে। সব মামলারই চার্জশিট হলেও সাক্ষীর চরম সংকটে ঝুলে আছে বিচার কার্যক্রম, এমনটি দাবি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলমের।
সূত্র জানায়, বৌদ্ধপল্লী ট্যাজেডি নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিটি তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিলেও গত ৭ বছরে মামলার চূড়ান্ত শুনানির অগ্রগতি হয়নি। ঘটনার হোতাদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল গঠন করা হলেও সাক্ষীর কারণে মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। ফলে এসব মামলার আইনি কার্যক্রম নিয়ে সংশয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে বিচারকার্য নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও সম্প্রীতিতে আস্থার সংকট অনেকটা কেটেছে।
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে কোরআন অবমাননাকর ছবি পোস্ট করাকে কেন্দ্র করে দুর্বৃত্তরা কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ চালিয়ে ধ্বংস করে ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও ২৬টি বসতঘর। রামু থেকে এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে উখিয়া ও টেকনাফসহ চট্টগ্রামের পটিয়া পর্যন্ত। এক শ্রেণির ধর্মান্ধরা বৌদ্ধপল্লী ও মন্দিরে উদ্দেশ্যমূলক হামলা চালায়। সেই সময় পুড়ে যায় রামুর বহু বছরের পুরনো এসব বৌদ্ধ বিহার। হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয় আরও ছয়টি বৌদ্ধ বিহার এবং শতাধিক বসতঘরে। পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেলে উখিয়া ও টেকনাফে আরও চারটি বৌদ্ধবিহারে হামলা হয়। পুড়ে যায় বিহারে থাকা হাজার বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
এ ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়। এর মধ্যে রামু থানায় আটটি, উখিয়ায় সাতটি, টেকনাফে দুটি ও কক্সবাজার সদর থানায় দুটি মামলা রেকর্ড হয়। এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে।
কক্সবাজার আদালতের কোর্ট পরিদর্শক পারভেজ তালুকদার বলেন, ১৯টি মামলার মাঝে রামু থানায় সুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দুই পক্ষের আপোস মীমাংসার ভিত্তিতে খারিজ করে দেন আদালত। বাকি ১৮টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন এবং সবগুলো মামলাই সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে আছে। তবে উপযুক্ত সাক্ষী না পাওয়ায় এসব থমকে আছে মামলার গতি। নাম-ঠিকানা ধরে পাওয়া যাচ্ছে না মামলার বেশিরভাগ সাক্ষীকে। যাদের পাওয়া যায় তাদের অনেকে আবার আসামির পক্ষে কথা বলায় চিহ্নিত হচ্ছেন ‘বৈরি সাক্ষী’ হিসেবে।
কক্সবাজার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, রামুর উখিয়ার ঘোনা জেতবন বৌদ্ধ বিহার, লট উখিয়ারঘোনা জাদীপাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহার ও ফতেখাঁরকুলের লালচিং, সাদাচিং ও মৈত্রী বিহার এবং চাকমারকুল ইউনিয়নের অজান্তা বৌদ্ধ বিহার এবং উখিয়ার একটি মামলা আদালত থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই’র কাছে পাঠানো হয়েছিল। তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের শেষের দিকে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়া হয়। সাক্ষী পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে অনেককে শনাক্ত করে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, বৌদ্ধপল্লী ট্রাজেডির এসব মামলায় বেশিরভাগ সাক্ষীই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তালিকাভুক্তরা ভয়ে সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। আর যে কয়জন সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারা বলেছেন উল্টো। তাই বেশিরভাগ সাক্ষীকে ‘বৈরী’ ঘোষণা করেছেন আদালত। সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিলম্বিত হচ্ছে বিচার কার্যক্রমও।
রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ সূত্র জানায়, বৌদ্ধপল্লী ট্র্যাজেডির সব মামলার বাদীই পুলিশ। পুলিশ কাকে আসামি করেছে, কাকে বাদ দিয়েছে ক্ষতিগ্রস্তরা কিছুই জানে না। যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এদের অনেকের নাম অভিযোগপত্রে নেই। এ অবস্থায় ভয়ে সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না সাক্ষীরা।
কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, বৌদ্ধপল্লী ট্র্যাজেডির কারণে রামুর সহস্র বছরের গর্ব ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে’ যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল তা কেটেছে। সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত হলে সম্প্রীতির জায়গাটা আরও সমৃদ্ধ হবে।
সচেতন মহলের দাবি, বৌদ্ধপল্লীতে হামলার ঘটনায় ছবি ও ভিডিও ফুটেজে দেখা মেলা ঘটনার সঙ্গে জড়িত অনেকেই মামলা থেকে বাদ পড়েছেন। আবার রহস্যজনক কারণে আসামি হয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীসহ নিরহ অনেকে। ফলে সাক্ষীরা স্বাক্ষ্য দিতে অনিহা প্রকাশ করে। সেই দিনের স্থিরচিত্র ধরে যদি আদালত বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করে তাহলে বাদপড়া প্রকৃত অপরাধীসহ মামলার আসামিরা শাস্তির আওতায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তারা।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) ও জেলা পুলিশের মুখপাত্র মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, মোট ১৮টি মামলা চলমান রয়েছে। এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। অনেকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন, অনেকে আত্মসমর্পণ করে জামিন পেয়েছেন। যেসব আসামি পলাতক রয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনার প্রচেষ্টা চলছে।
এদিকে, ঘটনার পর পরই সরকার সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগকে দিয়ে পুড়ে যাওয়া বৌদ্ধমন্দিরগুলো অত্যাধুনিক সুরম্য অট্টালিকা হিসেবে গড়ে দিয়েছে। নানা সহযোগিতায় গড়ে দেয়া হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত বসতবাড়িও। মন্দির সুরক্ষায় দেয়া হয়েছে নিরাপত্তাকর্মী।
এ বিষয়ে রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ একুশে পদক প্রাপ্ত বৌদ্ধধর্মীয় গুরু সত্যপ্রিয় মহাথের বলেন, আমাদের শত-সহস্র বছরের ঐতিহ্য পুড়ে গেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা আমাদের অর্ধশত বছর এগিয়ে দিয়েছেন। আমরা পুরনো সময়ের মতো অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সবধর্মের লোকজন একীভূত হয়ে চলতে চাই।
পাঠকের মতামত: